
ডাকসু নির্বাচন
তিন প্যানেলের ইশতেহার ঘোষণা সবারই প্রতিশ্রুতি নারীবান্ধব ক্যাম্পাস
- আপলোড সময় : ০২-০৯-২০২৫ ০৫:৩০:১১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-০৯-২০২৫ ০৫:৩০:১১ অপরাহ্ন


চলতি মাসের ৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। এখন চলছে প্রচারণা, যা চলবে ৭ তারিখ পর্যন্ত। ইতোমধ্যে সকল প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আদাজল খেয়ে নেমেছেন প্রচারণায়। যাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের দ্বারে দ্বারে, তাদের কর্মপরিকল্পনা জানিয়ে ভোট চাচ্ছেন। ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণার অন্যতম মাধ্যম হলো ইশতেহার। কোন প্রার্থী নির্বাচিত হলে কী করতে চায় সেটি শিক্ষার্থীরা জেনে-বুঝে তারপর পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দেবেন। তাই যেকোনও নির্বাচনে ইশতেহার অত্যন্ত জরুরি।
ডাকসু নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ইশতেহার ঘোষণা করেছে তিনটি প্যানেল। বাকিরা না করলেও ৩ তারিখের মধ্যে বেশির ভাগ সংগঠনই ইশতেহার ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে। এখন পর্যন্ত ‘ছাত্রদলের আবিদ-হামীম-মায়েদ পরিষদ, বাম জোটের প্রতিরোধ পরিষদ, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ এই তিনটি প্যানেল ইশতেহার ঘোষণা করেছে। প্রত্যেকেই নারীবান্ধব, গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ১০ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে ছাত্রদলের প্যানেল।
তাদের ইশতেহারের মধ্যে রয়েছে:
১. শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে আধুনিক, আনন্দময়, বসবাসযোগ্য, ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা; ২. নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস, নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি; ৩. শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যবিমা নিশ্চিত করা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণ ও চলাচল সহজতর করা; ৪. কারিকুলাম, অবকাঠামো ও পরীক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং গবেষণার মানোন্নয়ন; ৫. পরিবহন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, ব্যাটারিচালিত শাটল সার্ভিস প্রচলন এবং যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ করা। ৬. হয়রানিমুক্ত প্রশাসনিক সেবা, শিক্ষাঋণ এবং ক্যাম্পাসভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা; ৭. তরুণদের গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্তকরণ এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি; ৮. শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল সুবিধা, সাইবার সিকিউরিটি এবং সাইবার বুলিং প্রতিরোধ; ৯. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, সবুজায়ন ও প্রাণিবান্ধব ক্যাম্পাস তৈরি; এবং ১০. কার্যকর ডাকসু এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিকরণ।
এরপর ৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেল। এসব দফায় শিক্ষার্থীদের কল্যাণে প্রায় ৫০টি ইস্যুতে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে প্যানেলটি।
ইশতেহারের ৮ দফা:
১. ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত নিশ্চিত করা, জাতীয় রাজনীতির মহড়া ও ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির অবসান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনকারীদের বিচারের আওতায় আনা; ২. অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক গণতান্ত্রিক সংস্কার: স্বচ্ছ নিয়োগ নীতিমালা, ওয়ান স্টপ সলিউশন, পেপারলেস প্রশাসন, এলএমএস বিস্তার, ডিজিটাল ক্লাসরুম, ল্যাব আধুনিকায়ন, শিক্ষক মূল্যায়ন, নতুন স্টাডি স্পেস, ক্রেডিট ট্রান্সফার এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাজুড়ে সিসিটিভি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা; ৩. শিক্ষার্থীদের কল্যাণ: ওয়ান কার্ড অল সার্ভিস চালু, ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান সিট নীতি বাস্তবায়ন, আবাসন সংকট নিরসনে ভর্তুকি ও অ্যাটাচমেন্ট, স্বাস্থ্যবিমা, মেডিক্যাল সেন্টার আধুনিকায়ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাপটপে সুদবিহীন ঋণ। শিক্ষার্থীদের জন্য হোম টিউটর সার্ভিস ও ঢাকা শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টিং সার্ভিস চালু করা; ৪. শিক্ষার্থীর মর্যাদা: দাড়ি-টুপি, বোরকা-হিজাবসহ পোশাক ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে মোরাল পুলিশিং রোধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং ভিন্ন ধর্ম, জাতিসত্তা ও মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য বন্ধ; ৫. ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি: স্টারলিংকের মাধ্যমে উচ্চগতি ইন্টারনেট, এডুরোমের মাধ্যমে ফ্রি ওয়াইফাই, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চক্রাকার বাস, ওয়ান কার্ড অল সার্ভিস বাস্তবায়ন, টিএসসি ও ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় ভর্তুকিযুক্ত খাবার এবং বিভিন্ন ভবনে নতুন ক্যান্টিন স্থাপন। শিক্ষার্থীদের জন্য হোম টিউটরিং সার্ভিস; ৬. ক্যারিয়ার ও দক্ষতা উন্নয়ন: সেন্ট্রাল ও সায়েন্স লাইব্রেরি আধুনিকায়ন, ২৪ ঘণ্টা লাইব্রেরি সেবা, ই-লাইব্রেরি, এফবিএস ডাটা সেন্টার চালু, ক্যারিয়ার ক্লাব, আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা হাব গঠন; ৭. সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রম: ঢাবির নিজস্ব মিউজিয়াম ও কালচারাল সেন্টার, আধুনিক জিমনেশিয়াম ও গেমসরুম, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং হলভিত্তিক খেলার মাঠ সংস্কার; এবং ৮. নারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রস্তাবনা: নারী হলগুলোতে খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি, ২৪ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, মেয়েদের নামাজের স্থান প্রসার, অনাবাসিক নারীদের হলে প্রবেশাধিকার এবং জনপরিসর নারীবান্ধব করা।
গতকাল (৩১ আগস্ট) ১৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে প্রতিরোধ পর্ষদ। তার মধ্যে রয়েছে:
১. ডাকসুর কাঠামোর সংস্কার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি: অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে কেন্দ্রীয় এবং হল সংসদ নির্বাচনের তারিখ সুনির্দিষ্টকরণ, সিনেটের কোরাম পূর্ণ করতে ন্যূনতম দুজন নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধির উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা রেখে ৭৩-এর অধ্যাদেশ সংশোধনকরণ, সিনেটে ৫ জন নয়, ন্যূনতম ১০ জন নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি রাখার বিধান যুক্ত করা;
২. শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন করে শিক্ষার মানোন্নয়ন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সংকোচন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে গৃহীত ইউজিসির কৌশলপত্র বাতিল করা; ৩. গবেষণায় অগ্রাধিকার: বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজেটে অন্তত ১০ ভাগ গবেষণা খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিটি গবেষণাগারের আধুনিকায়নের ব্যবস্থা করা; ৪. আবাসন সংকট নিরসন: সব হলে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব বন্ধ করা। পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার, সম্প্রসারণ এবং নতুন ভবন নির্মাণ করতে প্রশাসনকে বাধ্য করা। প্রথম বর্ষ থেকেই প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে সিট নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে গণরুম, গেস্টরুম ও র?্যাগিং প্রথা নিষিদ্ধ করে ক্যাম্পাস চার্টার প্রকাশ এবং হলগুলোতে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা কার্যকর করা; ৫. নারীবান্ধব ক্যাম্পাস: প্রতিটি ফ্যাকাল্টি, নারী হল ও ডিপার্টমেন্টগুলোতে কার্যকরী ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন। নারী হলে ‘লোকাল গার্ডিয়ান’ নামক হয়রানি নির্মূলসহ হলের যাবতীয় হয়রানিমূলক নিয়ম-কানুনের অবসান ঘটানো। এছাড়া নারীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা প্রত্যাহার করা। নারীদের হলে আবাসিক-অনাবাসিক নারী শিক্ষার্থীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা; ৬. সব জাতিসত্তার অধিকার নিশ্চিতকরণ: পাহাড় ও সমতলে সব জাতিসত্তার ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। সব জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা; ৭. খাদ্য এবং পুষ্টিমান সুরক্ষা: হলগুলোতে ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্যান্টিন নয়, প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ক্যাফেটেরিয়া চালু করা; ৮. শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা: শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিক্যাল সেন্টারকে আধুনিক এবং ন্যূনতম ১০০ শয্যায় উন্নীত করা; ৯. মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা: মেডিক্যাল সেন্টারের আওতায় ‘মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট সেন্টার’ গড়ে তোলা এবং অনলাইন-অফলাইনে সেবা দেওয়া। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি, পুষ্টি, ব্যায়াম এবং মানসিক প্রশান্তি বিষয়ে কর্মশালার আয়োজন করা; ১০. লাইব্রেরি, সেমিনার, রিডিং রুম এবং কমনরুম: কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত রাখা। নতুন লাইব্রেরি ভবন নির্মাণ এবং ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা; ১১. প্রকাশনা সংস্থাকে সচল করা: বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থাকে সচল করা এবং নিয়মিত বিভিন্ন বই ও গবেষণাপত্র প্রকাশ করা। মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ সূচনা করা; ১২. মুক্ত পরিসর পুনরুদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণ: বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহাত হওয়া জমি পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করা; ১৩. সাহিত্য এবং সংস্কৃতি: হল-অনুষদে নিয়মিত সাহিত্য- সংস্কৃতি বিষয়ক আড্ডার আয়োজন করা। সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা। প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী লোক-উৎসবের আয়োজন করা। ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের সংস্কৃতি তুলে ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা; ১৪. পরিবহন: বিআরটিসি থেকে ভাড়াভিত্তিক নয়, নিজস্ব অর্থায়নে বাস কেনা; ১৫. ক্রীড়া: বার্ষিক স্পোর্টস ক্যালেন্ডার তৈরি করা যা অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বিত হবে। খেলার মাঠ নারীবান্ধব করা; ১৬. পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা; ১৭. গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও মতপ্রকাশের অধিকার: ৭৩-এর অধ্যাদেশের অগণতান্ত্রিক ধারা বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। প্রশাসনিক এবং অ্যাকাডেমিক কোনও কাজেই রাষ্ট্র-সরকারের হস্তক্ষেপ চলবে না; এবং ১৮. মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন: মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা, গবেষণা বৃত্তি নিশ্চিত এবং ত্রৈমাসিক প্রকাশনা বের করা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ